আন্তর্জাতিক মাদক বিরোধী দিবস আজ

ফেনসিডিল ইয়াবার পর দেশে আইসের বিস্তৃতি

সাহাদাত হোসেন পরশ •

ফেনসিডিল ও ইয়াবার পর নেশা হিসেবে এখন ক্রিস্টাল মেথ বা আইস ‘জনপ্রিয়’ হয়ে উঠছে। প্রায়ই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে জব্দ হচ্ছে আইস। দেশে যেসব রুট দিয়ে ইয়াবা ঢুকছে, তার প্রায় সব ক’টি দিয়ে আইসও আসছে। দেশের যে কোনো প্রান্তে হাত বাড়ালেই এখনও মিলছে ইয়াবা ও ফেনসিডিল। একইভাবে আইসও ছড়িয়ে পড়ছে। এদেশে তুলনামূলক নতুন এই মাদক ঠেকানোকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা।

এ রকম পরিস্থিতিতে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে আজ রোববার দেশে পালিত হবে আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য- ‘মাদক সেবন রোধ করি, সুস্থ সুন্দর জীবন গড়ি’।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সালে সব সংস্থা মিলে ইয়াবা জব্দ করেছে ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার। ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ১০ লাখ ৮ হাজার বোতল। কোকেন জব্দ করা হয় প্রায় ৪ কেজি, হেরোইন ২১০ কেজি। ২০২১ সালে মাদক-সংক্রান্ত ৪৭ শতাংশ মামলায় আসামির সাজা হয়েছে। এই হার ২০২০ সালে ছিল ৪৩ শতাংশ।

গত বছর ১৩ হাজার ৯০৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৫ হাজার ২০৬ জনকে গ্রেপ্তার করে সাজা দেওয়া হয়। ২০২০ সালে ২৩ হাজার ১৯৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে দণ্ড দেওয়া হয় ১০ হাজার ৪৯৮ জনকে।

এ ছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণে ঢাকা ও টেকনাফের জন্য গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। এর আওতায় সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদনেও আইসের ক্ষতিকর দিক উঠে এসেছে। এতে বলা হয়, এটি শক্তিশালী আসক্তি সৃষ্টিকারী মাদক। এতে আসক্ত ব্যক্তির ক্ষুধামান্দ্য ও প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পায়। অতিরিক্ত উত্তেজনা সৃষ্টি করে উচ্চ রক্তচাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে অনেকে সহিংস আচরণও করেন। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মাদক নিয়ন্ত্রণে আন্তঃবাহিনী ও সংস্থার সমন্বয় নিশ্চিত করা বড় চ্যালেঞ্জ। মাদকের চাহিদা, সরবরাহ ও ক্ষতি হ্রাস এবং নানামুখী কাজে ১১টি মন্ত্রণালয় জড়িত।

২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করেছিল র‌্যাব। এরপর পৃথকভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালায় পুলিশ, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। একের পর এক ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটে। অনেকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’কে মাদক নির্মূলে শেষ ভরসা মনে করলেও এটা খুব ফলপ্রসূ হয়নি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রধান রাসায়নিক কর্মকর্তা দুলাল কৃষ্ণ সাহা বলেন, আইস ঠেকানো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। আইস সেবন করলে কারও স্ট্রোক হতে পারে। হার্ট অ্যাটাক হতে পারে। মানসিক অবসাদ বা বিষণ্ণতার কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।

নতুন অপ্রচলিত মাদক ছাড়াও দেশে দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন হাত বাড়ালেই এখনও পাওয়া যাচ্ছে। নতুন মাদকের মধ্যে ম্যাজিক মাশরুম, এমডিএমএ ও এলএসডি দেশে আনতে সামাজিক মাধ্যমকে প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশেষ করে ইনস্টাগ্রাম ও রেডিটে কিছু পেইজ পাওয়া গেছে, যা বৈশ্বিক মাদক কারবারিদের মধ্যে যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। নতুন নতুন কৌশলে মাদক স্থানান্তর হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও ধরা পড়ছে মাদকের চালান। তবে জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ইউএনওডিসি) তথ্য বলছে, বাংলাদেশে যত মাদক ঢুকছে তার মাত্র ১০ শতাংশ ধরা পড়ে।

দেশে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে বারিধারা ও মোহাম্মদপুরে আইসের বড় চালান জব্দ হয়। এর পরই নড়চড়ে বসে সব সংস্থা। আইস কখনও লবণের দানার মতো দেখতে, কখনও চিনি বা মিছরির মতো শক্ত থাকে। ক্যান্ডি বা লজেন্সের মতো চুষে খেতে খেতে একসঙ্গে পথ চললেও কারও সন্দেহ করার উপায় নেই। রাজধানীর জিগাতলায়ও আইস তৈরির কারখানার সন্ধান মেলে। মালয়েশিয়ায় পড়াশোনা শেষে বাংলাদেশে আইস তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করেন এক তরুণ।

১৮৮৭ সালে জার্মানিতে সর্বপ্রথম পরীক্ষামূলকভাবে আইস প্রয়োগ করা হয়। তখন জঙ্গিবিমানের পাইলটদের দীর্ঘক্ষণ নির্ঘুম, নির্ভয় ও উত্তেজিত রাখতে এটি ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটা আরও ছড়িয়ে পড়ে। তবে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়ের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাবের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০ সালে এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়।